সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন

সাজেক ভ্যালির রুইলুইয়ের ঢালে তখনও ভোরের আলো পুরোপুরি নামেনি। মেঘ এসে ছুঁয়ে যায় চুল, জলের মতো মৃদু। চারপাশে পাহাড়ের নীরবতা, মাঝেমধ্যে পাখির ডাকে তা ভেঙে যায়, আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি কাঠের বারান্দায়, গরম চায়ের কাপ হাতে। এমন মুহূর্তেই কারো একটা মেসেজ আসে—”সাজেকে এখন যাওয়া কি নিরাপদ?”

মন খারাপ হয় না, কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। যে প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে ভয় কীসের?

— এই প্রশ্নটা যেন এখন প্রতিটি ভ্রমণপ্রেমীর মুখে মুখে। ফেসবুকে কোনো গ্রুপে সাজেক নিয়ে পোস্ট করলেই প্রথম কটি মন্তব্যের মধ্যে এটি অনিবার্যভাবে থাকে। অনেকের মনে ভয় বা দ্বিধা—

  • পাহাড়ে অশান্তি আছে কি না?
  • এখন সাজেক যাওয়া যায়?
  • সাজেক নাকি বন্ধ?
  • নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কি না?
  • পরিবার নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না?
sajek morning
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 5

বারবার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্তি ভর করলেও, একবার যখন সত্যিটা জানা যায়, তখন উত্তর দেওয়া হয়ে উঠে গর্বের ব্যাপার। সত্যি বলতে কী, সাজেক এখন বাংলাদেশের অন্যতম নিরাপদ পর্যটন গন্তব্য গুলোর একটি। এটার পেছনে রয়েছে সুসংগঠিত নিরাপত্তা বলয়ের একটি পরিশীলিত কাঠামো। এই পাহাড়, এই মেঘ, এই পথ—সবই তো এখন পাহারা দেওয়া নিঃশব্দ ছায়ার মতো শক্ত এক নিরাপত্তা বলয়ে বাঁধা। এই লেখায় আমি বলবো, সাজেক কেন নিরাপদ, কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, আর এই পাহাড়ি যাত্রায় কীভাবে ভয় নয় বরং আস্থা অর্জিত হয়—প্রকৃতির গল্প বলার ছলে।

খাগড়াছড়ি থেকে শুরু সেই আস্থা-ভরসার যাত্রা

সাজেকে আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল খাগড়াছড়ির শাপলা চত্ত্বর থেকে সকালবেলা, দিঘিনালার পথে গাড়ি ছুটে চলে কুয়াশার ভিতর দিয়ে। প্রতিটি বাঁক যেন এক নতুন দৃশ্যপট। পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে দীঘিনালার পথে যেতে যেতে দেখি, প্রতিটি বাঁকে বাঁকে পাহারায় আছে পরিচ্ছন্নতা ও কর্তব্যে দৃঢ় কিছু চোখ। এই পাহাড়ি রাস্তায় প্রতিটি ধাপেই থাকে নজরদারি—সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট, আনসার ক্যাম্প আর পুলিশ ফাঁড়ির নিরাপত্তা বলয়।

দীঘিনালায় বাঘাইহাট চেকপোস্টে যাত্রী/ড্রাইভারের নাম, ফোন নম্বর রেজিস্ট্রি হয়। এরপর গাড়ি গুলো যাত্রা করে নির্ধারিত সময়ে, নিরাপত্তা স্কট-এর সঙ্গে। এখানে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে গাড়ি গুলো স্কট দিয়ে সাজেক আনা-নেওয়া হয়। সময়সূচির বাইরে গাড়ি উঠা/নামা নিষিদ্ধ। এই নিয়ম অনেকের কাছে প্রথমে বাড়তি ঝামেলা মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি একমাত্র কারণ, যার জন্য সাজেকে পরিবারসহ যাওয়া এখন নির্ভরতার প্রতীক। সাজেকের পথে যাওয়া-আসা এখন হয় নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী, নিরাপত্তা স্কট দিয়ে। একসঙ্গে গাড়িগুলো চলে—সামনে-পেছনে সেনা/পুলিশ পাহারায়। সেই যাত্রা যেন একধরনের আস্থা ও অভিভাবকত্বের প্রতীক। প্রতিটি বাঁক পেরিয়ে, প্রতিটি ঢালু রাস্তা ডিঙিয়ে মনে হয়, কেউ একজন নিরবে বলছে—“চলো, ভয় নেই। এই পাহাড় তোমার জন্যই শান্ত।”

chander gari
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 6

নিরাপত্তা মানে শুধু অস্ত্র নয়—এটা আস্থার ছায়া

সাজেকের পাহাড়ি পথ সরু, আঁকাবাঁকা, কিন্তু তাতেও কোনো ভয় নেই। কারণ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে আছে পুলিশ ফাঁড়ি। স্থানীয় প্রশাসন সবসময় সচেতন, পর্যটকদের যেকোনো প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। একটা অচেনা স্থানে যখন মানুষ এই প্রস্তুতি দেখে, তখন ভয় আপনাআপনি উবে যায়।

পথে যেতে যেতে দেখি, ছোট ছোট ট্রাইবাল পাড়া গুলো নিস্তব্ধ, কিন্তু জীবন্ত। স্থানীয়রা হাসিমুখে থাকায়, ছোট ছোট শিশুরা হাত নাড়াতে নাড়াতে ছুটে আসে অর্ভ্যথনায়। তাদের চোখে-মুখে সরলতা ও হাসিমাখা মুখ, মনের অজান্তে আপনি হাসিমাখা মুখে মুগ্ধচাহনীতে দেখবেন আর হাত নাড়াবেন শুভেচ্ছা বিনিময়ে। ইচ্ছা হলে গাড়ি থামিয়ে কথা বলতে পারেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারেন, পারেন তাদের উপহার দিতে। এই মানুষ গুলো শান্তিপ্রিয়, পর্যটকদের বন্ধু ভাবেই দেখে। তাও যদি কখনো কিছু ঘটে—সেটা যেন স্রেফ ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রম যা সাধারণত বদলায় না।

সাজেক যেতে যেতে চোখে পড়ে বিজিবি ক্যাম্প, সেনা টহল, আর পাহাড়ি পুলিশ ফাঁড়ি।

আর যখন সাজেকের রুইলুই পৌঁছে মেঘ ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করি, তখন মনে হয়—এখানে থাকার জন্য শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষের ভালোবাসা আর রাষ্ট্রের সুরক্ষাও আছে। বিজিবির ক্যাম্প, সেনা চেকপোস্ট, পুলিশ টহল—সব মিলে সাজেক যেন হয়ে উঠেছে পাহাড়ের বুকের এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।

এই সুরক্ষাবলয় কেবল আইনশৃঙ্খলার জন্য নয়—এটি আপনাকে সাহস জোগায়, যেন আপনি নির্ভয়ে মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারেন।

সাজেকে রাত: মেঘ, চাঁদ, আর নীরব পাহারা

রুইলুই গ্রামে সন্ধ্যা নামে মেঘের চাদর গায়ে জড়িয়ে। গরম কফির কাপ হাতে যখন বারান্দায় দাঁড়ান, তখন হয়তো মোবাইলের সিগন্যাল নেই, কিন্তু মনে হয়—আপনি একদম সুরক্ষিত। সন্ধ্যা নামতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে শুরু হতে থাকে লাইভ মিউজিক। সবার অংশগ্রহণে সুরের তালে তালে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়, কে ট্যুরিষ্ট আর কেবা স্থানীয়?
সবার আড্ডা গানে সময় ঘনিয়ে রাত গভীর হয়। রাতে পাহাড়ি রাস্তায় টহল দেয় পুলিশের গাড়ি, বিজিবির সদস্যরা অবস্থান নেয় ক্যাম্পে, সেনা সদস্যরা পাহাড়ের মাথায় টহল দেন—নীরবে, কিন্তু স্থিরভাবে। সাজেকে রাত্রি মানে নিস্তব্ধতা, কিন্তু তাতে ভয় নেই।

IMG 20230927 203833
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 7

নির্জনতা আছে, কিন্তু নিঃসঙ্গতা নয়।

সেই রাতে আমরা হাঁটতে বের হই রুইলুই পাড়া হয়ে হ্যালিপেডের দিকে। অল্প অল্প বাতি জ্বলছে ঘরে ঘরে। সুরেবেসুরে ভেসে আসা গানে কখনো আপনাকে ভয় জাগাবে না। রাতে হ্যালিপেডে বসে কাটিয়ে দিতে পারেন সারারাত। কেউ এসে আপনার বিরক্তির কারণ হবেনা।হয়তো বাংলাদেশের একমাত্র পর্যটন কেন্দ্র যেখানে আপনি আপনার সঙ্গী নিয়ে সারারাত উপভোগ করতে পারেন প্রকৃতির সাথে।

কংলাক ট্রেইল: সীমান্ত ঘেঁষা, তবু আতঙ্কহীন

পরদিন সকালে আমরা যাই কংলাক পাহাড়ের দিকে। খুব সকালে, যখন সূর্য ঠিক ওঠেনি, পাহাড়ের মাথা তখনো মেঘে ঢেকে আছে। পথটা সরু, ঢালু, দুইপাশে জুম চাষের জমি। এই পাহাড়ি পথের প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে নজরদারি। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দূরের মিজোরাম দেখা যায়—সীমান্তের ওপার। অথচ কোনো ভয় নেই। এতটা সীমান্তঘেঁষা হয়েও সাজেকে কেন ভয় হয় না? কারণ এখানকার সীমান্ত নিয়ন্ত্রিত, শান্ত এবং সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

স্থানীয় মানুষরাই সাজেকের গোপন প্রহরী

পাহাড়ি মানুষদের মুখে ভয় নেই। বরং তারা অতিথিকে দেখে হাসে, পথ দেখায়, সাহায্য করে। রাস্তার পাশে বসা কোন স্থানীয়দের সাথে আপনি আড্ডা জমাতে পারেন। এই মানুষ গুলো ভয় দেখায় না, বরং আশ্বাস দেয়। আপনার যে কোন সমস্যায় সমাধানে সচেষ্ট থাকেন, সমাধানে চেষ্টা করেন নিজের মতো করে। স্থানীয়দের মধ্যে সেই নির্ভরতার আলো রয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আরেকটি স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায় সাজেকের নিরাপত্তায়। আপনি হারিয়ে গেলেও তারা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

এই আতিথেয়তা সাজেকের আরেকটি ‘নিরাপত্তা বর্ম’—যা হয়তো বাহিনীর অস্ত্রে নেই, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে আছে।

আস্থার নাম কটেজ এন্ড রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশন অফ সাজেক

ট্যারিস্ট স্পটে সবাই ব্যবসা করবে এটাই খুবই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিই। কিন্তু আপনার চোখে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরা দিবে সাজেক। বাংলাদেশের হয়তো একমাত্র ট্যুরিস্ট স্পট যেখানে রুম ভাড়া গুলো নির্ধারিত। আপনি নির্ধারিত ভাড়ার কমে রুম নিতে পারেন, কিন্তু আপনার কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া রাখবে এমন নজির নেই। এই ব্যাপারে সমিতি খুবই সচেতন। উনারা শুধু সচেতন তাইনা, সন্ধ্যার পর মাইকিং করেন নিয়মিত। আপনার যে কোন ধরনের বিপদে, উনাদের সাহায্য করার মানসিকতা আপনার মনে আস্থা বাড়াবে আরো বেশি। কখনো আপনি অনুভব করবেননা, বিপদে পড়বেন। আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন, আপনি আছেন আপনালয়ে, নিজের মতো করে।

485754035 1047520314067383 801102908691449399 n
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 8

তিনদিন সাজেকে কাটিয়ে ফেরার সময় যখন আমরা আবার সেই আঁকাবাঁকা পথে নামছি, তখন রাস্তার ধারে এক জায়গায় দেখি, কয়েকজন সেনা সদস্য দাঁড়িয়ে আছে। একজন পর্যটকবাহী জিপ গাড়ীর ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে, গাড়ীর ট্যারিস্টরা গাড়ী থেকে নেমে স্থানীয় শিশুদের চকলেট দিচ্ছে।

এই দৃশ্য মনের ভেতর দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়—নিরাপত্তা মানে যে কেবল অস্ত্র নয়, সেটা যেন পাহাড়ের মানুষগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

ফেরার পথে গাড়ির মধ্যে বসে আবার সেই প্রশ্নটাই মাথায় আসে—“সাজেকে যাওয়া কি এখন নিরাপদ?”

আমি জানি, উত্তরটা এখন শুধু তথ্য দিয়ে নয়, অভিজ্ঞতা দিয়েও দেওয়া যায়।

কারণ আমি দেখেছি—

  • কিভাবে প্রতিটি পর্যটককে নিবন্ধন করা হয়,
  • কিভাবে গাড়িগুলো একত্রে পাহাড়ে ওঠে,
  • কিভাবে প্রতিটি মোড়ে পাহারা দেয় কেউ না কেউ,
  • আর কিভাবে রাতের নিস্তব্ধতায় পাহাড়ের চূড়ায় একজন সেনা দাঁড়িয়ে পাহাড়টা আমাদের জন্য পাহারা দেয়।

সাজেক এখন কেবল ভ্রমণস্থান নয়, এক ধরনের আশ্রয়

সাজেক এখন শুধু একটি ভ্রমণস্থান নয়, বরং এক প্রকার আশ্বাস। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য মিলে যায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে।। স্থানীয় জনসাসাধারণ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন—সবাই মিলে সাজেককে বানিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের অন্যতম নিরাপদ পর্যটন গন্তব্য।

তাই যারা এখনও দ্বিধায়—

“সাজেকে যাওয়া কি এখন নিরাপদ?”

তাদের জন্য একটাই উত্তর:

সাজেকে ভয় নেই, এখানে বৃষ্টির ফোঁটার মতোই টপটপ করে নামে বিশ্বাস, মেঘের মতোই নরম হয় সুরক্ষা, আর পাহাড়ের মতোই দৃঢ় হয় প্রতিটি মুহূর্ত।

এই লেখাটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। তিন দিনের ভ্রমণে আমি যে আস্থা ও নিরাপত্তা অনুভব করেছি, তা-ই এখানে তুলে ধরেছি। আপনার যদি সাজেক নিয়ে প্রশ্ন থাকে বা ভ্রমণের আগে জানতে চান কিছু, মন্তব্যে জানাতে পারেন।

বর্ষায় সাজেকঃ মেঘ, পাহাড় ও ভালবাসার এক রোমান্টিক রাজ্য

পাহাড় তার রূপ পাল্টায় ঋতু অনুযায়ী। শীতের কুয়াশায় মোড়া শূন্যতা, গ্রীষ্মে ঝলমলে রোদ্দুরে পাথরের কঠোরতা আর বসন্তে ফুলে ফুলে ছড়ানো রঙের উৎসব — এসবই পাহাড়ের বিচিত্র রূপ। কিন্তু পাহাড় যখন বর্ষায় ভিজে উঠে, তখন যেন এক ভিন্ন আবেশে নিজেকে সাজায়। তখন সে হয় কোমল, মায়াবী, প্রেমিকের মতো আবেগপ্রবণ। আর সেই বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের রূপ সবচেয়ে মোহনীয় হয়ে ওঠে সাজেকে।

সাজেক যেন বর্ষায় হয়ে ওঠে প্রকৃতির এক স্বর্গীয় ক্যানভাস, যেখানে মেঘেরা খেলে বেড়ায়, বৃষ্টি বাজায় প্রেমের সুর, আর প্রতিটি বাঁক ও ঘুরপথ হয়ে ওঠে রোমান্টিকতার ঠিকানা।

বাঘাইহাট থেকে সাজেক — বৃষ্টির পথে প্রেমের যাত্রা
বাঘাইহাট থেকে সাজেক যাওয়ার রাস্তাটি যেন প্রকৃতির বুকে আঁকা এক মোহময় রেখাচিত্র। বিশেষ করে বর্ষাকালে, সবুজে মোড়া গাছেরা মাথা ঝুঁকিয়ে যেন স্বাগত জানায়। পাহাড়ের গায়ে মেঘ লেগে থাকে অবিরাম, কখনো ঢেকে দেয় রাস্তা, কখনো শুধু একটুখানি ফাঁক রেখে জানিয়ে দেয় — আরেকটু এগোলেই স্বপ্নপুরী।

গাড়ির জানালা খুলে দিলে ঠাণ্ডা বাতাসে মন ভরে যায়, সাথে থাকে কুয়াশা আর রোমান্টিক গান। কল্পনা করুন, বৃষ্টির ছাটে জানালা ভিজে যাচ্ছে, আপনি গানের তালে মাথা দোলাচ্ছেন আর পাশের মানুষটি চুপ করে আপনাকে দেখছে — এমন মুহূর্ত বৃষ্টি ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়।

সাজেক — মেঘের রাজ্যে এক রোমান্টিক সকাল

সাজেকে বর্ষাকালে পা রাখার মুহূর্ত থেকেই মনে হবে, আপনি যেন কোনো রূপকথার রাজ্যে ঢুকে পড়েছেন। চারদিকে শুধু সবুজ পাহাড়, তার গায়ে মেঘের পর্দা নেমে আসে ধীরে ধীরে। কোনো কোনো সকালে ঘুম ভাঙে জানালার বাইরে ভেসে বেড়ানো মেঘের ঝাঁক দেখে — এমন দৃশ্য হয়তো কল্পনাতেও আসে না। আর এমন দৃশ্য দেখতে আপনাকে রিসোর্টা পছন্দ করতে হবে মিজোরাম ভিউ এবং যে রুম থেকে বসে উপভোগ করা যায়।

সাজেকের প্রতিটি সকাল বর্ষায় থাকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, মেঘমাখা। আলো আর ছায়ার খেলা চলে সারাদিন। কিছুক্ষণ পরপরই এক এক ঝাপটা বৃষ্টি নেমে আসে পাহাড়ের গায়ে, আবার কিছু সময় পর ঝলমলে রোদ উঠলে পাহাড়ের গা থেকে বাষ্প ওঠে — এক অনিন্দ্য দৃশ্য। ঠিক তখনই আপনি বুঝবেন, কেন সাজেককে মেঘের রাজ্য বলা হয়।

সাজেকের ভোরে সূর্য ওঠে মেঘের চাদরের নিচ থেকে কাঁপতে কাঁপতে, যেন কোনো শিশুর ঘুম ভাঙে মায়ের আদরে। পাহাড়ের গায়ে তখন আলো এসে পড়ে কুয়াশার ফিতের মতো। খোলা বারান্দায় কিংবা মাচায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিকযুগল যেন এই প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এক অন্তরঙ্গ আলাপে।
এক কাপ গরম চা হাতে, প্রিয়জন পাশে, মেঘের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে —
“তুমি আমি আর মেঘেরা”

বর্ষার সাজে পাহাড়ের রহস্যময়তা
বর্ষায় সাজেকের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো তার চঞ্চলতা আর আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা। কখনো রোদের ঝিলিক, কখনো হালকা বৃষ্টি, আবার হঠাৎ করে ঘন মেঘে চারদিক অন্ধকার — এ এক দারুণ অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের পিচঢালা রাস্তা ভিজে চকচক করে, মাঝে মাঝে রাস্তার দু’পাশে ঝরনার শব্দ শোনা যায়। জলের ধারা নেমে আসে পাহাড়ের গা বেয়ে।

সেই মুহূর্তে, আপনি হাঁটছেন রেইনকোট পরে, পেছনে আপনার প্রিয়জন, কাঁধে ব্যাকপ্যাক — হয়তো কথা কম, কিন্তু অনুভব তীব্র। এমন এক মুহূর্ত জীবনের সঞ্চয়ে চিরদিন থেকে যায়। এই ভেজা রাস্তায় হাত ধরে হাঁটা যেন অতীতের কোনো কবিতার পঙক্তির মতো — যা হারিয়ে গেলে আবার ফিরে আসে একটুখানি বৃষ্টিতে।

রুম থেকে মেঘ 1
বর্ষায় সাজেকঃ মেঘ, পাহাড় ও ভালবাসার এক রোমান্টিক রাজ্য 13

রুইলুই পাড়া ও কংলাক — বৃষ্টির গল্পে জড়ানো পাহাড়গ্রাম
সাজেকের মূল গ্রাম রুইলুই পাড়া, আর একটু উপরে কংলাক পাড়া — এই দুই জায়গা যেন পাহাড়ের বুকের মাঝে দুটি নিঃশব্দ রত্ন। এই গ্রামদুটোতে বর্ষায় এমন এক সৌন্দর্য নেমে আসে, যা শুধু চোখে দেখা নয়, হৃদয়ে অনুভবের।

সকালে কুয়াশার চাদর যেন শীতল আলিঙ্গন হয়ে জড়িয়ে ধরে। দুপুরে সূর্যের ঝলক পাহাড়ের গায়ে পড়ে সৃষ্টি করে স্বর্ণাভ রেখা। আর বিকেলে, এক পশলা বৃষ্টির পর যখন রংধনু ওঠে আকাশে, তখন মনে হয় — এ যেন স্বর্গ থেকে পাঠানো কোনো চিত্রশিল্প।

কংলাক পাড়া থেকে নিচের দিকে তাকালে মেঘের সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। মনে হয় আপনি যেন কোনো দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছেন, যার চারপাশে শুধু মেঘ — সাদা, নরম, মায়াবী। প্রিয়জনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয়, এই পৃথিবীটা আমাদের দুজনের জন্যই তৈরি হয়েছে।

রোমান্টিক মুহূর্ত ও বর্ষার ভালবাসা
বর্ষায় পাহাড়ে হেঁটে বেড়ানো মানেই হাতে হাত রেখে, বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে প্রেমে নতুন আবিষ্কার। কাদা মাখা রাস্তা, মাঝে মাঝে পা পিছলে যাওয়া, আর সেই ছায়ার মতো পাশে থাকা প্রিয়জন — তখন আপনি শুধু হাঁটছেন না, প্রেমের পথে হেঁটে চলেছেন।

একটি চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে এক কাপ গরম লিকার চা হাতে, কাঁপতে থাকা হাতে প্রিয় মানুষটির চা তুলে দেওয়া — এইসব ছোট ছোট মুহূর্তই তো জীবনের আসল রোমান্স। আপনি তখন প্রেমিক, পথিক ও কবি — সব একসাথে।

nature 1
বর্ষায় সাজেকঃ মেঘ, পাহাড় ও ভালবাসার এক রোমান্টিক রাজ্য 14

বর্ষায় রাতের সাজেক — নীরবতার প্রেমকাব্য
রাতের সাজেক বর্ষায় আরও রহস্যময়। চারদিক নীরব, শুধু দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক। গা ছমছমে বাতাস আপনাকে জড়িয়ে ধরে, আর মনের মধ্যে জেগে ওঠে কিছু চিরচেনা, চিরঅচেনা অনুভূতি।

কখনো রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কখনো ছাউনির নিচে বসে, শুধু চুপচাপ সময় কাটানো — কথা না বলেও অনেক কিছু বলা যায় এই রাতগুলোতে। এমন রাতে পাহাড় যেন নিজেই তার প্রেমের কবিতা পড়ে:

“আমরা কেউই আর পৃথিবীতে নেই,
এ যেন কেবল তুমি আমি আর অসীম প্রকৃতি।”

বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কিছু জরুরি টিপস

বর্ষায় সাজেক বেড়াতে গেলে কিছু প্রস্তুতি থাকা খুবই জরুরি। নিচে দেওয়া হলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ:

১. রেইনকোট ও ছাতা: হালকা, সহজে ভাঁজ করা যায় এমন রেইনকোট সঙ্গে রাখুন। ছাতা থাকলেও ঝড়ো হাওয়ার জন্য অনেক সময় ব্যবহার করা যায় না, তাই রেইনকোট বেশি কার্যকর।

২. ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগ ও ব্যাগ কাভার: আপনার ব্যাগ ওয়াটারপ্রুফ না হলে অবশ্যই ব্যাগ কাভার ব্যবহার করুন, বিশেষ করে ক্যামেরা বা ইলেকট্রনিক জিনিস থাকলে।

৩. ওয়াটারপ্রুফ জুতো বা স্যান্ডেল: স্লিপার বা হিল নয়, গ্রিপযুক্ত ওয়াটারপ্রুফ ট্র্যাকিং জুতো ব্যবহার করলে পাহাড়ি পথে হাঁটতে সুবিধা হবে।

৪. প্লাস্টিক বা জিপ-লক ব্যাগ: ফোন, মানিব্যাগ, পাসপোর্ট বা কাগজপত্র রাখতে এগুলো খুব কাজে দেয়। পানির সংস্পর্শে না আসার জন্য এগুলো ব্যবহার করুন।

৫. হালকা ও দ্রুত শুকনো জামা-কাপড়: কটন জামা এড়িয়ে চলুন, বরং ড্রাই-ফিট বা সিনথেটিক কাপড় ব্যবহার করুন যা সহজে শুকায়।

৬. প্রাথমিক চিকিৎসার সামগ্রী: বর্ষায় সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে, তাই প্রাথমিক কিছু ওষুধ ও ব্যান্ডেজ রাখুন।

৭. পাওয়ার ব্যাংক ও টর্চ: পাহাড়ি এলাকায় বিদ্যুৎ কখনও কখনও না-ও থাকতে পারে, তাই এগুলো সাথে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

সাজেক এক বার নয়, বার বার ঘুরে দেখার মতো জায়গা। তবে বর্ষায় তার রূপ ও অনুভব একেবারে আলাদা মাত্রার। এখানকার বৃষ্টি যেন শুধুই ভিজিয়ে দেয় না, মনেও গেঁথে যায়। পাহাড়ের গায়ে যখন মেঘেরা নেমে আসে, তখন তা প্রেমেরই রূপ নেয়। সাজেক তখন শুধুই ভ্রমণের স্থান নয়, হয়ে ওঠে ভালোবাসার গন্তব্য। যদি প্রকৃতি আর প্রেম একসাথে উপভোগ করতে চান, তবে বর্ষাকালেই হোন সাজেকের মিজোরাম ভিউ ফদাংতাং রিসোর্টের অতিথি।

আর মনে রাখবেন — বৃষ্টি শুধু ভেজায় না, ভালবাসাও জাগায়।

সাজেক শুধু একটি স্থান নয়, একটি অনুভব, একটি কবিতা, একটি প্রেম। বর্ষায় তার প্রতিটি বাঁক যেন প্রেমের পঙক্তিমালা। মেঘের রাজ্যে দাঁড়িয়ে আপনি যে অনুভব করবেন, তা কোনো ছবিতে ধরা যায় না — তা হৃদয়ে গেঁথে থাকে চিরকাল।

“ভালোবাসা যদি হয় একটি মেঘ,
তাহলে সাজেক সে মেঘের ঠিকানা।”

বর্ষায় সাজেকে গিয়ে আপনি শুধু ভিজবেন না, আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন — একজন প্রেমিক, একজন কবি, একজন পর্যটক হিসেবে।

বৈশাখে সাজেক — পাহাড়ের রোমান্টিক রূপ ও বৃষ্টির মুগ্ধতা

বাংলাদেশের অনেক স্বপ্নিল স্থান মানুষের হৃদয়ে একান্ত জায়গা করে নেয়। কিন্তু যে জায়গাটি প্রকৃতির সঙ্গে নিঃশব্দে প্রেম করতে শেখায়, তার নাম সাজেক। বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার এক বিস্ময়কর স্থান এটি, যা পাহাড়, মেঘ আর সূর্যের আলিঙ্গনে এক অপার সৌন্দর্য ধারণ করে। ঋতুর পালাবদলে বৈশাখ মাসে সাজেক যেন এক ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়। খরতাপ আর হঠাৎ আসা কালবৈশাখির ঝড় মিলিয়ে এই সময়টায় সাজেক হয় কখনো রোমাঞ্চকর, কখনো স্নিগ্ধ, আবার কখনো রোমান্টিকতায় ভরা এক আবেশময় প্রেমের উপত্যকা।

সাজেক ভ্যালির যাত্রা শুরু হয় খাগড়াছড়ি থেকে। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে সাজেকে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা, তবে সেই পথ যেন প্রতিটি মুহূর্তে নতুন অভিজ্ঞতা দেয়। চারপাশে পাহাড়ের ঢেউ, নিচে সবুজ বন, আর মাথার উপরে খোলা আকাশ — মনে হয়, জীবন যেন হঠাৎ থমকে গেছে প্রশান্তির কোলে। বৈশাখের রোদের তাপ পথে কিছুটা ক্লান্তি আনলেও পাহাড়ি বাতাস আর দৃশ্যপট সেই ক্লান্তিকে নিমিষেই মুছে দেয়।

cloud in sajek
বৈশাখে সাজেক — পাহাড়ের রোমান্টিক রূপ ও বৃষ্টির মুগ্ধতা 18

ভোরের সাজেকের কথা যদি বলি, তবে বলতে হয়, সেটি যেন এক স্বপ্নের আলোর নগরী। সূর্যোদয়ের সময় সাজেকের মেঘে ঢাকা পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে আলোর ঝলকানিতে জেগে ওঠে। এ যেন প্রেমের প্রথম স্পর্শ—কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন, কিছুটা লাজুক, আবার অন্তরের গভীর থেকে আগত। যারা ভোরে উঠে ‘হেলিপ্যাড’ পয়েন্টে যান, তারা দেখেন মেঘের সাগরে ডুবে থাকা গ্রামগুলো, যেখানে সাদা মেঘের মাঝে পাহাড়ের চূড়া মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে এক মায়াবী দৃশ্য—যেন আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে কেউ স্বপ্ন দেখছে।

বেলা বাড়লে সূর্যের তাপে সাজেক কিছুটা গরম হয়ে ওঠে, তবে সেই গরম আমাদের শহরের মতো নয়। এখানে প্রকৃতির মাঝে থেকেও একটা হালকা রোমাঞ্চ কাজ করে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঝিরঝিরে বাতাস, কোথাও মেঘের খণ্ড খণ্ড ভেলা, আর পাখির ডাক যেন এক নিঃসঙ্গ দুপুরকে করে তোলে সঙ্গতিপূর্ণ। বৈশাখের এই গরমের মধ্যেও সাজেক শান্ত, ধীর এবং ভালোবাসাময়।

তবে প্রকৃতির সবচেয়ে চমকপ্রদ ও রোমান্টিক রূপ দেখা যায় বিকেল গড়াতেই। হঠাৎ করেই আকাশের রঙ বদলে যায়। চারপাশের সবুজ রঙ যেন ধূসর হয়ে ওঠে। দূরে দিগন্তে কালো মেঘ জমে, বিদ্যুৎ চমকায়, বাতাসে শীতলতা নেমে আসে। এ সময় বুঝি যে, কালবৈশাখির আগমন ঘটতে চলেছে। শুরু হয় বৃষ্টি—প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা, তারপর ঝমঝমিয়ে। পাহাড়ের গায়ে সেই বৃষ্টির শব্দ যেন প্রকৃতির ভালোবাসার গান। যারা সঙ্গী নিয়ে সাজেকে যান, তাদের জন্য এই সময়টা একান্ত, অন্তর্মুখী, আর পরম রোমান্টিক।

ফদাংতাং মাচা
বৈশাখে সাজেক — পাহাড়ের রোমান্টিক রূপ ও বৃষ্টির মুগ্ধতা 19

ফদাংতাং রিসোর্টের বারান্দা কিংবা খোলা মাচায় বসে চা হাতে পাহাড়ে ঝরতে থাকা বৃষ্টি দেখার অনুভূতি ভাষায় বোঝানো যায় না। সেখানে শব্দ হয় শুধু বৃষ্টির, আর চোখে থাকে শুধু প্রকৃতির। এমন মুহূর্তে দু’জন মানুষের নিঃশব্দ তাকানো, কিছু না বলেও সব বলা হয়ে যাওয়া—এসবই সাজেকের বৈশাখী বৃষ্টির রূপে ধরা দেয়। মাঝে মাঝে মেঘ এসে আপনাকে ছুঁয়ে যাবে পরম ভালবাসায়।

বৃষ্টির পরে সাজেক আরও বেশি মনকাড়া হয়ে ওঠে। বৃষ্টির ফোঁটা গাছের পাতায় জমে থাকে, রাস্তায় পড়ে থাকা জলকণাগুলো সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করে। পাহাড়ি পথ তখন নতুন করে জেগে ওঠে। সবুজ আরও গাঢ় হয়, আকাশ হয় ধোয়া তুলোর মতো পরিষ্কার। সন্ধ্যার দিকে দূরের গ্রামের আলো জ্বলে ওঠে, বাতাস হয় আরও ঠান্ডা, আর মনের ভিতর জন্ম নেয় প্রশান্তির এক নীরব গান।

রাতের সাজেকও কম নয়। বৈশাখী সন্ধ্যায় হালকা চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ যখন মাচায় এসে দাঁড়ায়, তখন তারা দেখতে পায় নক্ষত্রে ভরা আকাশ, গাঢ় পাহাড়ের কালো ছায়া আর রেস্টুরেন্ট গুলো থেকে ভেসে আসা গিটারের সুর। প্রেম সেখানে যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে শব্দের বাইরে চলে যায়।

বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা পাহাড়ের গায়ে পড়ে যেন সংগীত তোলে। দু’জন মিলে যদি ছাতা হাতে সাজেকের কোনো নির্জন কোণে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে বুঝবে প্রকৃতি কীভাবে প্রেমের ভাষায় কথা বলে। মেঘের গায়ে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে দূরের গ্রাম, নিচে জঙ্গল, আর ওপরে ধোঁয়াটে আকাশ। এই সময়টুকু যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়—শুধু তুমি, তোমার প্রিয়জন আর পাহাড়ের একান্ত মুহূর্ত।

nature
বৈশাখে সাজেক — পাহাড়ের রোমান্টিক রূপ ও বৃষ্টির মুগ্ধতা 20

তবে এই রোমান্টিক সৌন্দর্যের মাঝে প্রস্তুতিও থাকা দরকার, বিশেষ করে হঠাৎ বৃষ্টি আর ঝড়ের জন্য।
বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে যা করা দরকার:
১. ছাতা ও রেইনকোট সঙ্গে রাখা: বৃষ্টি শুরু হলে যেন দৌড়ে গেস্ট হাউসে ফিরতে না হয়।
২. পানিরোধী ব্যাগ ও মোবাইল কভার: ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র যেন নিরাপদে থাকে।
৩. জলসহনশীল জুতা ও অতিরিক্ত কাপড়: ভিজে গেলে পরার জন্য সঙ্গে অতিরিক্ত হালকা কাপড় রাখা ভালো।
৪. গরম পানীয় ও ওষুধ: বৃষ্টির পর ঠান্ডা লাগতে পারে, তাই গরম চা-কফির ব্যবস্থা ও হালকা সর্দির ওষুধ রাখা ভালো।
৫. শীতের পাতলা চাদর বা জ্যাকেট: পাহাড়ে সন্ধ্যায় তাপমাত্রা নেমে যায়, তাই হালকা কিছু গায়ে দেওয়ার জন্য রাখা উচিত।

সাজেকে বৈশাখ মানেই শুধু পাহাড় দেখার ভ্রমণ নয়, এটি এক ধরণের আত্ম-অনুভব, এক প্রেমময় সংযোগ, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষের হৃদয় মিলে এক হয়ে যায়। একা হলেও, সঙ্গী থাকলেও—এই জায়গাটি এমন কিছু দেয়, যা শহরের ব্যস্ততায় পাওয়া যায় না।

এটি সেই জায়গা, যেখানে হঠাৎ বৃষ্টিও প্রেমের চিঠির মতো লাগে, ঝড়ো হাওয়া হয় এক প্রেমিকের নিঃশ্বাস, আর মেঘ হয় প্রেয়সীর আবেশে মোড়ানো পর্দা।

 

গরমে স্বস্তি অফার

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যেমন বিমোহিত করে, রুদ্ররোষ করে তেমনি উতলা ও বিক্ষুব্ধ হলেও প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে বয়ে যেতে পছন্দ করে।
এপ্রিল-মে এই সময়টায় গ্রীষ্মের খরতাপে চারপাশ পুড়তে থাকলেও প্রকৃতি যে কী অপূর্ব মহিমায় ভরে ওঠে!
বসন্তে ওই অর্থে বৃক্ষরা পত্রবতী হয়ে ওঠে না; যে অর্থে গ্রীষ্মে গাছপালা পরিপূর্ণতা পায়। একটিও বৃক্ষের শাখা পাওয়া যাবে না, যাতে কচি সবুজ পাতায় ভরে না ওঠে।
এই কচি সবুজ পাতাগুলো এপ্রিল-মে মাসে এসে গায়ে গতরে বিশেষ দ্যোতনা ধারণ করে ধারণ করে গাঢ় সবুজে, পাহাড়ের চূড়ায় মিজোরাম ভিউ রিসোর্টের মাচার উপর বসে দেখলে মনে হয় যেন চারপাশে সবুজ গালিচায় মোড়ানো!!
আপনজনকে নিয়ে এই রূপ উপভোগ করতে পারেন আমাদের আঙিনায়। যদি কালবৈশাখি শুরু হয়, এতটুকু বলতে পারি এই রূপের বর্ণনা দেয়া অসম্ভব।

প্যাকেজ প্রাইজ: ৩৭০০/- (দুই জনের জন্য)

প্যাকেজে যা যা সংযুক্ত
১. এক রাতের জন্য কাপল রুম (অদ্রি/ আভা/আইচুক/নিম্বাস)

  • মিজোরাম ভিউ রুম
  • রুমের সাথে ব্যক্তিগত বারান্দা
  • হাই কমোড যুক্ত এটাষ্ট বাথরুম
  • গিজার
  • বিছানায় শুয়ে মেঘ, বৃষ্টি, সূর্য, চাঁদ ও তারার মেলা দেখার অনুভূতি।
  • খোলামেলা উন্মুক্ত মিজোরাম ভিউ মাচা

২. তিন বেলা খাবার

দুপুরের খাবার

ব্যাম্বু চিকেন, ভর্তা (আলু, বেগুন, শুটকি), মিক্সড সবজি, ডাল, সাদা ভাত।

রাতের খাবার

বিবিকিউ (কোয়ার্টার মুরগী, মিক্সড সবজি, পরোটা, কোমল পানীয়)

সকালের নাস্তা:

খিচুড়ি, ডিম ভাজি, চা।

বিস্তারিত ও বুকিং কনফার্ম করতে আমাদের নাম্বারে কল করার অনুরোধ রইল।

অফারটি ৩১ মে ২০২৪ ইং পর্যন্ত প্রযোজ্য

সাজেকে কেন আপনি মিজোরাম ভিউ রুমে থাকবেন?

Odri Fodang Thang Resort

আঁকা বাঁকা পাহাড়ে চলার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিতে মূলত আমরা পাহাড়ে ছুটে যাই।

মুগ্ধ হয়ে হা হয়ে থাকি আমরা পুরো রাস্তা জুড়ে। কখনো নামে, আবার কখনো গাড়ি উঠে পড়ে কোন পাহাড়ের চূড়ায়। এই ভ্রমনে ক্লান্তি তেমন ভর করেনা, ক্লান্তি এসে ঠিক তখনি ভর করে যখন পথের শেষ হয়।

সাধারণত পাহাড়ের চূড়ায় এসে পথের শেষ হয়। প্রয়োজনে কটেজ বা রিসোর্ট গুলো এখানে তৈরি করা হয়। আমরা যেন পাহাড়ের চূড়ায় বসে প্রকৃতি উপভোগ করতে পারি।

রাঙামাটি জেলার সাজেকের কটেজ বা রিসোর্ট গুলো গড়ে উঠেছে পাহাড়ের চূড়ার রুইলুই পাড়ায়। রুইলুই পাড়ার মূল দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে যাওয়া সড়ককে কেন্দ্র করে রাস্তার দুপাশে গড়ে উঠেছে রিসোর্ট গুলো। রুইলুই পাড়ার তিনপাশ থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের অংশ, আর পূর্ব পাশের বিশাল বিশাল পাহাড়ের ভারতের মিজোরামের অংশ। দুইদেশকে আলাদা করে বয়ে চলছে সাজেক নদী। স্বাভাবিক ভাবে সৃষ্ট মেঘের ছুটে চলা কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে জমা হওয়াটা বেশির ভাগই হয় রুইলুই পাড়ার পূর্ব দিকে সাজেক নদীকে কেন্দ্র করে।

রুইলুই পাড়ার রিসোর্ট গুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে বসে বসে পাহাড়ের সৌন্দর্য ও মেঘের বিভিন্ন রূপ উপভোগ করতে। গড়ে উঠা রিসোর্ট গুলো পূর্ব ও পশ্চিম পাশে হওয়াতে সবারণত ভ্রমণপিয়াসীদের আগ্রহ থাকে মূলত পূর্ব পাশের অর্থাৎ মিজোরাম ভিউ রিসোর্টের দিকে।

Mizoram View Resort Sajek

মিজোরাম ভিউ অর্থাৎ পূর্ব দিকের রিসোর্ট গুলো থেকে মিজোরামের বড় বড় পাহাড়ের আড়াল থেকে মেঘ ভেদ করে উঠা সূর্য মামা, আপনাকে মুগ্ধ করবেই। মূলত বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট এই ভোরের, মেঘের ছবি দেখে সাজেকে আসতে আগ্রহী হয়ে উঠেন কিংবা সাজেক ঘুরতে আসেন।

বাংলাদেশের অংশ থেকে মিজোরামের পাহাড় গুলো অনেক বড় বড়। মিজোরাম পাহাড়ের পাদদেশে থেকে সাজেকের রুইলুই পাড়া পযর্ন্ত ভোরের সময় মেঘে ঢাকা থাকে।

স্বাভাবিক ভাবে পশ্চিম পাশে বা বাংলাদেশ ভিউ রিসোর্ট থেকে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে ভোরে উঠে হেলিপ্যাড কিংবা উঁচু কোন খোলা স্থানে যেতে হবে, যা আপনি যাচাই করে নিলে পূর্ব পাশ বা মিজোরাম ভিউ রুমে বসে কিংবা বারান্দায় বসে উপভোগ করতে পারবেন।

সকালে মেঘের আনাগোনা, রুমে মেঘের ছোঁয়া কিংবা মেঘের আড়াল থেকে লাল টকটকে সূর্য উঠার দৃশ্য দেখতে হলো আপনাকে পূর্ব পাশের অর্থাৎ মিজোরাম ভিউ রিসোর্টে রাত কাটাতে হবে। মিজোরাম ভিউ হলেও অনেক রিসোর্টের রুম থেকে কিন্তু এই দৃশ্য দেখা যায় না। হাতেগোনা কিছু রিসোর্ট আছে, যাদের প্রতিটি রুম থেকে এই ভিউ দেখা যায়।

তাই বুকিং দেয়ার সময় বিস্তারিত জেনে, বুঝে আপনার রুম বুকিং দিলে আপনার সাজেক ভ্রমণ ষোলআনা পরিপূর্ণ হবে।

জেনে রাখা ভাল

Mizoram View Resort Sajek

  • সাজেকের সৌন্দর্য সবচেয়ে ভাল পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউ পাশ থেকে।
  • সকালে মেঘ জমে পূর্ব বা মিজোরাম ভিউয়ের দিকে।
  • স্বাভাবিক ভাবে মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঠে পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউয়ের দিকে।
  • পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউ রিসোর্ট হলেও, অনেক রিসোর্ট থেকে মেঘ বা সূর্য উদয় দেথা যায়না।
  • পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউ রিসোর্ট হলেও, রিসোর্টে প্রতিটি রুম থেকে ভিউ ভাল পাওয়া যায়না।
  • পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউ রিসোর্ট হলেও, অনেক কম রুম থেকে মিজোরাম ভিউ ভাল পাওয়া যায়।
  • স্বাভাবিকভাবে পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউ রিসোর্টের যে রুম গুলো মিজোরাম ভিউ ভাল, তাদের ভাড়া একটু বেশি।
  • রুম বুকিং দেয়ার সময় রুম নাম্বার কিংবা নাম অনুসারে ছবি কিংবা ভিডিও দেথে রুম বুকিং করা উচিত।
  • পূর্ব কিংবা মিজোরাম ভিউ রিসোর্ট হলেও, প্রতিটি রুমের ভিউ সমান নাও হতে পারে।
  • রুম যদি সঠিক ভাবে নির্ধারণ করতে পারেন, হয়তো ঘুম ভেঙে দেখবেন আপনি মেঘের আড়ালে ডুব দিয়েছেন।

আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে, আমাদের কল করতে পারেন এই নাম্বারে 0181722572। আমাদের আপনি Facebook, Instagram, Pinterest, Twitter এ ফলো করতে পারেন। আমাদের রিসোর্টের ভিডিও YouTube Channel দেখতে পারেন। আমাদের রিসোর্টের গুগল ম্যাপ