সাজেক ভ্যালির রুইলুইয়ের ঢালে তখনও ভোরের আলো পুরোপুরি নামেনি। মেঘ এসে ছুঁয়ে যায় চুল, জলের মতো মৃদু। চারপাশে পাহাড়ের নীরবতা, মাঝেমধ্যে পাখির ডাকে তা ভেঙে যায়, আর আমি দাঁড়িয়ে থাকি কাঠের বারান্দায়, গরম চায়ের কাপ হাতে। এমন মুহূর্তেই কারো একটা মেসেজ আসে—”সাজেকে এখন যাওয়া কি নিরাপদ?”

মন খারাপ হয় না, কিন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। যে প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে ভয় কীসের?

— এই প্রশ্নটা যেন এখন প্রতিটি ভ্রমণপ্রেমীর মুখে মুখে। ফেসবুকে কোনো গ্রুপে সাজেক নিয়ে পোস্ট করলেই প্রথম কটি মন্তব্যের মধ্যে এটি অনিবার্যভাবে থাকে। অনেকের মনে ভয় বা দ্বিধা—

  • পাহাড়ে অশান্তি আছে কি না?
  • এখন সাজেক যাওয়া যায়?
  • সাজেক নাকি বন্ধ?
  • নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট কি না?
  • পরিবার নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি না?
sajek morning
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 5

বারবার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্তি ভর করলেও, একবার যখন সত্যিটা জানা যায়, তখন উত্তর দেওয়া হয়ে উঠে গর্বের ব্যাপার। সত্যি বলতে কী, সাজেক এখন বাংলাদেশের অন্যতম নিরাপদ পর্যটন গন্তব্য গুলোর একটি। এটার পেছনে রয়েছে সুসংগঠিত নিরাপত্তা বলয়ের একটি পরিশীলিত কাঠামো। এই পাহাড়, এই মেঘ, এই পথ—সবই তো এখন পাহারা দেওয়া নিঃশব্দ ছায়ার মতো শক্ত এক নিরাপত্তা বলয়ে বাঁধা। এই লেখায় আমি বলবো, সাজেক কেন নিরাপদ, কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, আর এই পাহাড়ি যাত্রায় কীভাবে ভয় নয় বরং আস্থা অর্জিত হয়—প্রকৃতির গল্প বলার ছলে।

খাগড়াছড়ি থেকে শুরু সেই আস্থা-ভরসার যাত্রা

সাজেকে আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল খাগড়াছড়ির শাপলা চত্ত্বর থেকে সকালবেলা, দিঘিনালার পথে গাড়ি ছুটে চলে কুয়াশার ভিতর দিয়ে। প্রতিটি বাঁক যেন এক নতুন দৃশ্যপট। পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে দীঘিনালার পথে যেতে যেতে দেখি, প্রতিটি বাঁকে বাঁকে পাহারায় আছে পরিচ্ছন্নতা ও কর্তব্যে দৃঢ় কিছু চোখ। এই পাহাড়ি রাস্তায় প্রতিটি ধাপেই থাকে নজরদারি—সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট, আনসার ক্যাম্প আর পুলিশ ফাঁড়ির নিরাপত্তা বলয়।

দীঘিনালায় বাঘাইহাট চেকপোস্টে যাত্রী/ড্রাইভারের নাম, ফোন নম্বর রেজিস্ট্রি হয়। এরপর গাড়ি গুলো যাত্রা করে নির্ধারিত সময়ে, নিরাপত্তা স্কট-এর সঙ্গে। এখানে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে গাড়ি গুলো স্কট দিয়ে সাজেক আনা-নেওয়া হয়। সময়সূচির বাইরে গাড়ি উঠা/নামা নিষিদ্ধ। এই নিয়ম অনেকের কাছে প্রথমে বাড়তি ঝামেলা মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি একমাত্র কারণ, যার জন্য সাজেকে পরিবারসহ যাওয়া এখন নির্ভরতার প্রতীক। সাজেকের পথে যাওয়া-আসা এখন হয় নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী, নিরাপত্তা স্কট দিয়ে। একসঙ্গে গাড়িগুলো চলে—সামনে-পেছনে সেনা/পুলিশ পাহারায়। সেই যাত্রা যেন একধরনের আস্থা ও অভিভাবকত্বের প্রতীক। প্রতিটি বাঁক পেরিয়ে, প্রতিটি ঢালু রাস্তা ডিঙিয়ে মনে হয়, কেউ একজন নিরবে বলছে—“চলো, ভয় নেই। এই পাহাড় তোমার জন্যই শান্ত।”

chander gari
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 6

নিরাপত্তা মানে শুধু অস্ত্র নয়—এটা আস্থার ছায়া

সাজেকের পাহাড়ি পথ সরু, আঁকাবাঁকা, কিন্তু তাতেও কোনো ভয় নেই। কারণ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে আছে পুলিশ ফাঁড়ি। স্থানীয় প্রশাসন সবসময় সচেতন, পর্যটকদের যেকোনো প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। একটা অচেনা স্থানে যখন মানুষ এই প্রস্তুতি দেখে, তখন ভয় আপনাআপনি উবে যায়।

পথে যেতে যেতে দেখি, ছোট ছোট ট্রাইবাল পাড়া গুলো নিস্তব্ধ, কিন্তু জীবন্ত। স্থানীয়রা হাসিমুখে থাকায়, ছোট ছোট শিশুরা হাত নাড়াতে নাড়াতে ছুটে আসে অর্ভ্যথনায়। তাদের চোখে-মুখে সরলতা ও হাসিমাখা মুখ, মনের অজান্তে আপনি হাসিমাখা মুখে মুগ্ধচাহনীতে দেখবেন আর হাত নাড়াবেন শুভেচ্ছা বিনিময়ে। ইচ্ছা হলে গাড়ি থামিয়ে কথা বলতে পারেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারেন, পারেন তাদের উপহার দিতে। এই মানুষ গুলো শান্তিপ্রিয়, পর্যটকদের বন্ধু ভাবেই দেখে। তাও যদি কখনো কিছু ঘটে—সেটা যেন স্রেফ ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রম যা সাধারণত বদলায় না।

সাজেক যেতে যেতে চোখে পড়ে বিজিবি ক্যাম্প, সেনা টহল, আর পাহাড়ি পুলিশ ফাঁড়ি।

আর যখন সাজেকের রুইলুই পৌঁছে মেঘ ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করি, তখন মনে হয়—এখানে থাকার জন্য শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষের ভালোবাসা আর রাষ্ট্রের সুরক্ষাও আছে। বিজিবির ক্যাম্প, সেনা চেকপোস্ট, পুলিশ টহল—সব মিলে সাজেক যেন হয়ে উঠেছে পাহাড়ের বুকের এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।

এই সুরক্ষাবলয় কেবল আইনশৃঙ্খলার জন্য নয়—এটি আপনাকে সাহস জোগায়, যেন আপনি নির্ভয়ে মেঘ ছুঁয়ে দেখতে পারেন।

সাজেকে রাত: মেঘ, চাঁদ, আর নীরব পাহারা

রুইলুই গ্রামে সন্ধ্যা নামে মেঘের চাদর গায়ে জড়িয়ে। গরম কফির কাপ হাতে যখন বারান্দায় দাঁড়ান, তখন হয়তো মোবাইলের সিগন্যাল নেই, কিন্তু মনে হয়—আপনি একদম সুরক্ষিত। সন্ধ্যা নামতে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে শুরু হতে থাকে লাইভ মিউজিক। সবার অংশগ্রহণে সুরের তালে তালে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়, কে ট্যুরিষ্ট আর কেবা স্থানীয়?
সবার আড্ডা গানে সময় ঘনিয়ে রাত গভীর হয়। রাতে পাহাড়ি রাস্তায় টহল দেয় পুলিশের গাড়ি, বিজিবির সদস্যরা অবস্থান নেয় ক্যাম্পে, সেনা সদস্যরা পাহাড়ের মাথায় টহল দেন—নীরবে, কিন্তু স্থিরভাবে। সাজেকে রাত্রি মানে নিস্তব্ধতা, কিন্তু তাতে ভয় নেই।

IMG 20230927 203833
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 7

নির্জনতা আছে, কিন্তু নিঃসঙ্গতা নয়।

সেই রাতে আমরা হাঁটতে বের হই রুইলুই পাড়া হয়ে হ্যালিপেডের দিকে। অল্প অল্প বাতি জ্বলছে ঘরে ঘরে। সুরেবেসুরে ভেসে আসা গানে কখনো আপনাকে ভয় জাগাবে না। রাতে হ্যালিপেডে বসে কাটিয়ে দিতে পারেন সারারাত। কেউ এসে আপনার বিরক্তির কারণ হবেনা।হয়তো বাংলাদেশের একমাত্র পর্যটন কেন্দ্র যেখানে আপনি আপনার সঙ্গী নিয়ে সারারাত উপভোগ করতে পারেন প্রকৃতির সাথে।

কংলাক ট্রেইল: সীমান্ত ঘেঁষা, তবু আতঙ্কহীন

পরদিন সকালে আমরা যাই কংলাক পাহাড়ের দিকে। খুব সকালে, যখন সূর্য ঠিক ওঠেনি, পাহাড়ের মাথা তখনো মেঘে ঢেকে আছে। পথটা সরু, ঢালু, দুইপাশে জুম চাষের জমি। এই পাহাড়ি পথের প্রতিটি বাঁকেই রয়েছে নজরদারি। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দূরের মিজোরাম দেখা যায়—সীমান্তের ওপার। অথচ কোনো ভয় নেই। এতটা সীমান্তঘেঁষা হয়েও সাজেকে কেন ভয় হয় না? কারণ এখানকার সীমান্ত নিয়ন্ত্রিত, শান্ত এবং সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

স্থানীয় মানুষরাই সাজেকের গোপন প্রহরী

পাহাড়ি মানুষদের মুখে ভয় নেই। বরং তারা অতিথিকে দেখে হাসে, পথ দেখায়, সাহায্য করে। রাস্তার পাশে বসা কোন স্থানীয়দের সাথে আপনি আড্ডা জমাতে পারেন। এই মানুষ গুলো ভয় দেখায় না, বরং আশ্বাস দেয়। আপনার যে কোন সমস্যায় সমাধানে সচেষ্ট থাকেন, সমাধানে চেষ্টা করেন নিজের মতো করে। স্থানীয়দের মধ্যে সেই নির্ভরতার আলো রয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আরেকটি স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায় সাজেকের নিরাপত্তায়। আপনি হারিয়ে গেলেও তারা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

এই আতিথেয়তা সাজেকের আরেকটি ‘নিরাপত্তা বর্ম’—যা হয়তো বাহিনীর অস্ত্রে নেই, কিন্তু মানুষের হৃদয়ে আছে।

আস্থার নাম কটেজ এন্ড রিসোর্ট ওনার্স এসোসিয়েশন অফ সাজেক

ট্যারিস্ট স্পটে সবাই ব্যবসা করবে এটাই খুবই স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিই। কিন্তু আপনার চোখে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরা দিবে সাজেক। বাংলাদেশের হয়তো একমাত্র ট্যুরিস্ট স্পট যেখানে রুম ভাড়া গুলো নির্ধারিত। আপনি নির্ধারিত ভাড়ার কমে রুম নিতে পারেন, কিন্তু আপনার কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া রাখবে এমন নজির নেই। এই ব্যাপারে সমিতি খুবই সচেতন। উনারা শুধু সচেতন তাইনা, সন্ধ্যার পর মাইকিং করেন নিয়মিত। আপনার যে কোন ধরনের বিপদে, উনাদের সাহায্য করার মানসিকতা আপনার মনে আস্থা বাড়াবে আরো বেশি। কখনো আপনি অনুভব করবেননা, বিপদে পড়বেন। আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন, আপনি আছেন আপনালয়ে, নিজের মতো করে।

485754035 1047520314067383 801102908691449399 n
সাজেক: মেঘ পাহাড়ের মাঝে নিরাপত্তার আলিঙ্গন 8

তিনদিন সাজেকে কাটিয়ে ফেরার সময় যখন আমরা আবার সেই আঁকাবাঁকা পথে নামছি, তখন রাস্তার ধারে এক জায়গায় দেখি, কয়েকজন সেনা সদস্য দাঁড়িয়ে আছে। একজন পর্যটকবাহী জিপ গাড়ীর ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে, গাড়ীর ট্যারিস্টরা গাড়ী থেকে নেমে স্থানীয় শিশুদের চকলেট দিচ্ছে।

এই দৃশ্য মনের ভেতর দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়—নিরাপত্তা মানে যে কেবল অস্ত্র নয়, সেটা যেন পাহাড়ের মানুষগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

ফেরার পথে গাড়ির মধ্যে বসে আবার সেই প্রশ্নটাই মাথায় আসে—“সাজেকে যাওয়া কি এখন নিরাপদ?”

আমি জানি, উত্তরটা এখন শুধু তথ্য দিয়ে নয়, অভিজ্ঞতা দিয়েও দেওয়া যায়।

কারণ আমি দেখেছি—

  • কিভাবে প্রতিটি পর্যটককে নিবন্ধন করা হয়,
  • কিভাবে গাড়িগুলো একত্রে পাহাড়ে ওঠে,
  • কিভাবে প্রতিটি মোড়ে পাহারা দেয় কেউ না কেউ,
  • আর কিভাবে রাতের নিস্তব্ধতায় পাহাড়ের চূড়ায় একজন সেনা দাঁড়িয়ে পাহাড়টা আমাদের জন্য পাহারা দেয়।

সাজেক এখন কেবল ভ্রমণস্থান নয়, এক ধরনের আশ্রয়

সাজেক এখন শুধু একটি ভ্রমণস্থান নয়, বরং এক প্রকার আশ্বাস। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য মিলে যায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর সঙ্গে।। স্থানীয় জনসাসাধারণ, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন—সবাই মিলে সাজেককে বানিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের অন্যতম নিরাপদ পর্যটন গন্তব্য।

তাই যারা এখনও দ্বিধায়—

“সাজেকে যাওয়া কি এখন নিরাপদ?”

তাদের জন্য একটাই উত্তর:

সাজেকে ভয় নেই, এখানে বৃষ্টির ফোঁটার মতোই টপটপ করে নামে বিশ্বাস, মেঘের মতোই নরম হয় সুরক্ষা, আর পাহাড়ের মতোই দৃঢ় হয় প্রতিটি মুহূর্ত।

এই লেখাটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। তিন দিনের ভ্রমণে আমি যে আস্থা ও নিরাপত্তা অনুভব করেছি, তা-ই এখানে তুলে ধরেছি। আপনার যদি সাজেক নিয়ে প্রশ্ন থাকে বা ভ্রমণের আগে জানতে চান কিছু, মন্তব্যে জানাতে পারেন।

Recommended Posts

No comment yet, add your voice below!


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *